হৃদরোগের প্রধান ঝুঁকিগুলোর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ও অতিরিক্ত ওজনের বিষয়টি বেশিরভাগ মানুষেরই জানা। কিন্তু অনেকেরই হৃদরোগের সমস্যা দেখা দিয়েছে, যদিও তাদের এসব প্রচলিত ঝুঁকি ছিল না। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গাউট (গেঁটে বাত), সোরিয়াসিস, অন্ত্রের প্রদাহ এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগগুলিও হৃদরোগের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।
হৃদরোগ ও প্রদাহের সম্পর্ক
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ হৃদরোগের অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসছে। গবেষকরা এখন কার্ডিওভাসকুলার রোগকে ধমনীর দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগ হিসেবে দেখছেন। একে বলা হয় এথেরোসেক্লরোটিক কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (ASCVD)। যখন ধমনির দেয়ালে চর্বি জমে, তখন এটি শক্ত হয়ে যায় এবং রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
প্রদাহ যেভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়
ধমনির দেয়ালে কোলেস্টেরল জমে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু হয় এন্ডোথেলিয়ামের (ধমনির ভেতরের আস্তরণ) ক্ষত থেকে। উচ্চমাত্রার লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) বা খারাপ কোলেস্টেরল, ধূমপানের বিষাক্ত পদার্থ, কিংবা অন্যান্য টক্সিনের কারণে এই ক্ষত তৈরি হতে পারে।
ক্ষত হলে শ্বেত রক্তকণিকা সেখানে এসে প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং প্রদাহ তৈরি করে। এই কণিকাগুলো ধমনির দেয়ালের লেগে থাকা কোলেস্টেরল শোষণ করে ফ্যাটি স্ট্রিক বা চর্বির দাগ তৈরি করে, যা সময়ের সঙ্গে জমে প্লেক তৈরি করে। এই প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে নিঃশব্দে চলতে পারে এবং একসময় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
নীরব প্রদাহ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি
যখন ধমনিতে জমে থাকা প্লেক ভেঙে যায়, তখন রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়। অনেকের মধ্যে কোনো স্পষ্ট ঝুঁকির লক্ষণ দেখা না দিলেও, ধমনির এই লুকায়িত প্রদাহ তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
প্রদাহ শনাক্তকরণের উপায়
শরীরে প্রদাহ পরিমাপের অন্যতম পরীক্ষার নাম উচ্চ-সংবেদনশীলতার সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন (hs-CRP)। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের hs-CRP এবং LDL কোলেস্টেরল দুটোই বেশি, তাদের কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
প্রদাহ কমানোর উপায়
গবেষকরা প্রদাহ কমানোর জন্য বিভিন্ন ওষুধ পরীক্ষা চালাচ্ছেন। যেমন, ক্যানাকিনুম্যাব নামক প্রদাহবিরোধী ওষুধ একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে ব্যবহৃত হয়েছে, যা হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা হ্রাস করলেও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এছাড়া তুলনামূলকভাবে সস্তা প্রদাহবিরোধী ওষুধ যেমন কোলচিসিন এবং মেথোট্রেক্সেট নিয়েও গবেষণা চলছে।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে প্রদাহ কমানো সম্ভব
ওষুধ ছাড়াও কিছু জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রদাহ কমানো যায়—
✅ ধূমপান বর্জন: সিগারেটের বিষাক্ত পদার্থ ধমনির প্রদাহ সৃষ্টি করে।
✅ পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস: ফল, শাকসবজি, দানাদার শস্য, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ তৈলাক্ত মাছ প্রদাহ কমায়।
✅ ব্যায়াম: নিয়মিত শরীরচর্চা প্রদাহের মাত্রা কমাতে সহায়ক।
✅ ওজন নিয়ন্ত্রণ: বিশেষ করে পেটের চারপাশের চর্বি কমানো দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
✅ মানসিক চাপ কমানো: স্ট্রেস বা অতিরিক্ত চাপ দেহে প্রদাহ বাড়ায়, তাই মেডিটেশন বা রিলাক্সেশন জরুরি।
✅ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: এগুলো ঠিক রাখলে প্রদাহজনিত হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
সচেতনতা ও প্রতিরোধই সেরা উপায়
হৃদরোগ প্রতিরোধে শুধু রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।