০৭:৫১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নামাজের প্রস্তুতি: সঠিক পদ্ধতি ও করণীয়

স্টাফ রিপোর্টার

নামাজকে বলা হয় দ্বীনের খুঁটি, যা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। আল্লাহ তায়ালা ইসলামের সব বিধান ওহির মাধ্যমে দিয়েছেন, তবে নামাজের বিধান তিনি সরাসরি আরশে আজিমে দাওয়াত দিয়ে রাসুল (সা.)-কে প্রদান করেন। নামাজের মাধ্যমে বান্দার আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়। এজন্য নামাজের আগে থেকেই সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নবী (সা.)-এর নামাজের প্রস্তুতির আদর্শ
রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের সময় হয়ে গেলে দুনিয়াবি কোনো কাজে মনোযোগ দিতেন না। সাহাবিরাও তাঁর এ আদর্শ মেনে চলতেন। তারা দুনিয়ার সব ব্যস্ততা ছেড়ে মসজিদের দিকে ছুটে যেতেন। নবীযুগে আজানের পর দোকানপাট খোলা থাকত না। আজানের সম্মানার্থেই তারা এটি করতেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে ইবনে মারদাওয়াই (রহ.) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘কতিপয় লোকের ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন করতে পারে না’ (সুরা নুর : ৩৭)। এই আয়াতের ফজিলত পাওয়ার আশায় সাহাবিরা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাঝেও নামাজকে প্রাধান্য দিতেন। আজান শুনলেই সব কাজ ফেলে মসজিদে ছুটে যেতেন।

সাহাবায়ে কেরামের অনুকরণীয় উদাহরণ
নবী (সা.) নামাজের যাতায়াত পথে মানুষকে সতর্ক করতেন এবং নামাজের প্রতি আহ্বান জানাতেন। তিনি বলতেন, “আজান শুনে ঈমান ও আমলের ভরসায় বসে থেকো না।” আবু বাকরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) ফজরের নামাজ পড়তে বের হয়ে যাদের ঘুমন্ত দেখতেন, তাদের পায়ে নাড়া দিতেন (আবু দাউদ : ১২৬৬)।

সাহাবিরাও নামাজের সময় কেনাবেচা বন্ধ রাখতেন। তারা সবকিছু ফেলে মসজিদে যেতেন। জায়েদ বিন খালেদ জুহানি (রা.) বলেন, আমরা কেনাবেচা বন্ধ করে নবী (সা.)-এর সঙ্গে মাগরিব পড়ে বাজারে ফিরে আসতাম।

নামাজের প্রতি গুরুত্ব আরোপের ধারাবাহিকতা
নবী (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী খলিফাদের সময়েও নামাজের প্রতি আহ্বান অব্যাহত ছিল। বিদায় হজের সময়ও রাসুল (সা.) লোকজনকে “নামাজ, নামাজ” বলে ডাকতেন (উসদুল গাবা : ৫/৫৩৬)।

ওমর (রা.) ফজরের নামাজের সময় ঘুমন্ত লোকদের জাগিয়ে তুলতেন এবং বাজারের লোকজনকে আল্লাহর ভয় প্রদর্শন করে নামাজের দিকে আহ্বান জানাতেন।

ইসলামি সভ্যতা ও বাজারের চিত্র
তৎকালীন আরবের বণিকেরা সুদূর গ্রাম থেকে মদিনায় এসে প্রথমেই নামাজ আদায় করতেন। আসবাগ বিন নুবাতা (রা.) বলেন, বাজারে লোকজন ফজরের নামাজ পড়ে আসার পরই বেচাকেনা শুরু করতেন।

হাসান বিন আলি (রা.) বর্ণনা করেন, আলি বিন আবু তালেব (রা.) মসজিদে যাওয়ার পথে লোকজনকে বলতেন, “নামাজ, নামাজ।” প্রতিদিনই তিনি এভাবে লোকজনকে সতর্ক করতেন।

উমাইয়া শাসকদের আমলেও এই ধারা চালু ছিল। সালেম বিন আবদুল্লাহ বিন ওমর বাজারে গিয়ে দেখতেন, লোকজন নামাজের জন্য তাদের পণ্যসামগ্রী ফেলে মসজিদের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

আজানের পর বাজারের অবস্থা
তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়ি যুগেও নামাজের সময় বাজার বন্ধ থাকত। বিশিষ্ট তাবেয়ি সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, তার যুগের মানুষজন ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও কারও ফরজ নামাজের জামাত মিস হতো না। (হিলিয়া)।

তালেব মক্কি (রহ.) তার রচিত ‘কুতুল কুলুব’ গ্রন্থে তৎকালীন হাটবাজারের আজানের সময়কার অবস্থা তুলে ধরেছেন, “মানুষজন আজান শুনে মসজিদে ছুটে আসত। তখন হাটবাজারে কোনো ক্রেতাবিক্রেতা অবস্থান করত না।”

উপসংহার
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘অতঃপর যারা তাদের উত্তরসূরি হয়েছে, তারা নামাজ নষ্ট করে ফেলেছে, কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। ফলে তারা ‘গাই’ নামক দোজখের সাক্ষাৎ পেয়েছে’ (সুরা মরিয়ম : ৫৯)।

তাই আল্লাহ যাদের হেদায়েত করেছেন, তাদের পথ অনুসরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্ম সবই করা যাবে, তবে নামাজের সময় হলে তা ফেলে রেখে মসজিদে যাওয়াই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপডেট সময় : ০৪:০৭:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
৭৫ বার পড়া হয়েছে

নামাজের প্রস্তুতি: সঠিক পদ্ধতি ও করণীয়

আপডেট সময় : ০৪:০৭:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

নামাজকে বলা হয় দ্বীনের খুঁটি, যা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। আল্লাহ তায়ালা ইসলামের সব বিধান ওহির মাধ্যমে দিয়েছেন, তবে নামাজের বিধান তিনি সরাসরি আরশে আজিমে দাওয়াত দিয়ে রাসুল (সা.)-কে প্রদান করেন। নামাজের মাধ্যমে বান্দার আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়। এজন্য নামাজের আগে থেকেই সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নবী (সা.)-এর নামাজের প্রস্তুতির আদর্শ
রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের সময় হয়ে গেলে দুনিয়াবি কোনো কাজে মনোযোগ দিতেন না। সাহাবিরাও তাঁর এ আদর্শ মেনে চলতেন। তারা দুনিয়ার সব ব্যস্ততা ছেড়ে মসজিদের দিকে ছুটে যেতেন। নবীযুগে আজানের পর দোকানপাট খোলা থাকত না। আজানের সম্মানার্থেই তারা এটি করতেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে ইবনে মারদাওয়াই (রহ.) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘কতিপয় লোকের ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন করতে পারে না’ (সুরা নুর : ৩৭)। এই আয়াতের ফজিলত পাওয়ার আশায় সাহাবিরা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাঝেও নামাজকে প্রাধান্য দিতেন। আজান শুনলেই সব কাজ ফেলে মসজিদে ছুটে যেতেন।

সাহাবায়ে কেরামের অনুকরণীয় উদাহরণ
নবী (সা.) নামাজের যাতায়াত পথে মানুষকে সতর্ক করতেন এবং নামাজের প্রতি আহ্বান জানাতেন। তিনি বলতেন, “আজান শুনে ঈমান ও আমলের ভরসায় বসে থেকো না।” আবু বাকরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) ফজরের নামাজ পড়তে বের হয়ে যাদের ঘুমন্ত দেখতেন, তাদের পায়ে নাড়া দিতেন (আবু দাউদ : ১২৬৬)।

সাহাবিরাও নামাজের সময় কেনাবেচা বন্ধ রাখতেন। তারা সবকিছু ফেলে মসজিদে যেতেন। জায়েদ বিন খালেদ জুহানি (রা.) বলেন, আমরা কেনাবেচা বন্ধ করে নবী (সা.)-এর সঙ্গে মাগরিব পড়ে বাজারে ফিরে আসতাম।

নামাজের প্রতি গুরুত্ব আরোপের ধারাবাহিকতা
নবী (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী খলিফাদের সময়েও নামাজের প্রতি আহ্বান অব্যাহত ছিল। বিদায় হজের সময়ও রাসুল (সা.) লোকজনকে “নামাজ, নামাজ” বলে ডাকতেন (উসদুল গাবা : ৫/৫৩৬)।

ওমর (রা.) ফজরের নামাজের সময় ঘুমন্ত লোকদের জাগিয়ে তুলতেন এবং বাজারের লোকজনকে আল্লাহর ভয় প্রদর্শন করে নামাজের দিকে আহ্বান জানাতেন।

ইসলামি সভ্যতা ও বাজারের চিত্র
তৎকালীন আরবের বণিকেরা সুদূর গ্রাম থেকে মদিনায় এসে প্রথমেই নামাজ আদায় করতেন। আসবাগ বিন নুবাতা (রা.) বলেন, বাজারে লোকজন ফজরের নামাজ পড়ে আসার পরই বেচাকেনা শুরু করতেন।

হাসান বিন আলি (রা.) বর্ণনা করেন, আলি বিন আবু তালেব (রা.) মসজিদে যাওয়ার পথে লোকজনকে বলতেন, “নামাজ, নামাজ।” প্রতিদিনই তিনি এভাবে লোকজনকে সতর্ক করতেন।

উমাইয়া শাসকদের আমলেও এই ধারা চালু ছিল। সালেম বিন আবদুল্লাহ বিন ওমর বাজারে গিয়ে দেখতেন, লোকজন নামাজের জন্য তাদের পণ্যসামগ্রী ফেলে মসজিদের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

আজানের পর বাজারের অবস্থা
তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়ি যুগেও নামাজের সময় বাজার বন্ধ থাকত। বিশিষ্ট তাবেয়ি সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, তার যুগের মানুষজন ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও কারও ফরজ নামাজের জামাত মিস হতো না। (হিলিয়া)।

তালেব মক্কি (রহ.) তার রচিত ‘কুতুল কুলুব’ গ্রন্থে তৎকালীন হাটবাজারের আজানের সময়কার অবস্থা তুলে ধরেছেন, “মানুষজন আজান শুনে মসজিদে ছুটে আসত। তখন হাটবাজারে কোনো ক্রেতাবিক্রেতা অবস্থান করত না।”

উপসংহার
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘অতঃপর যারা তাদের উত্তরসূরি হয়েছে, তারা নামাজ নষ্ট করে ফেলেছে, কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। ফলে তারা ‘গাই’ নামক দোজখের সাক্ষাৎ পেয়েছে’ (সুরা মরিয়ম : ৫৯)।

তাই আল্লাহ যাদের হেদায়েত করেছেন, তাদের পথ অনুসরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্ম সবই করা যাবে, তবে নামাজের সময় হলে তা ফেলে রেখে মসজিদে যাওয়াই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।